, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ , ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ


মাছের রাজ্যে মাছের সঙ্কট

  • আপলোড সময় : ১৭-০৮-২০২৩ ১১:৫৫:৪৬ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৭-০৮-২০২৩ ১১:৫৫:৪৬ পূর্বাহ্ন
মাছের রাজ্যে মাছের সঙ্কট
মোঃ আতিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ থেকে: এক সময় দেশব্যাপী মাছের রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিলো সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলাটি। কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবৎ এই উপজেলাতেই মাছের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক প্রজাতির মাছ। এলাকার বাজারগুলোতে পাওয়া যাচ্ছেনা দেশীয় মাছ। চাষের পাঙ্গাস মাছে সয়লাব এলাকার প্রতিটি হাট-বাজার। ”মৎস্য, পাথর, ধান সুনামগঞ্জের প্রাণ” প্রবাদে থাকলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়। 

এক সময় দেশীয় প্রজাতির মিঠা পানির সুস্বাদু মাছে ভরপুর থাকলেও বর্তমানে ধ্বংসের একেবারে দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে হাওর এলাকার মৎস্য ভান্ডার।  শেলু মেশিন দিয়ে বিলের তলা শুকিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মাছ শিকার, কারেন্ট জাল, কিরন মালা চাই, চায়না দুয়ারী দিয়ে মাছ শিকার করায়  নির্বংশ হয়ে যাচ্ছে কালি বাউশ, রাণী, বাছা, শিং, মাগুর, পাবদা, রাণীপুটি, শৌল, গজার, বোয়াল, খলিশা, টাকি, চিতল, বাইম, চিংড়ি, মিনি, কই, মলা, ঢেলা, কাইক্কা, আইড়সহ শতাধিক প্রজাতির মিঠাপানির সুস্বাদু মাছ।  

জানা গেছে, এক সময় টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বচ্ছ পানির ওপর দিয়ে নৌকা নিয়ে যাওয়ার সময় পানির নিচের নলখাগড়া আর বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ স্পষ্ট দেখা যেত। যার ফাঁকে ফাঁকে নৌকার গতির সঙ্গে সাঁতরে পাল্লা দিতো জানা-অজানা নানা ধরনের ছোট-বড় মাছ। এখন মাছের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তির পথে জলজ উদ্ভিদ।আগে টাঙ্গুয়ার হাওরে বিরল প্রজাতির ফিস পেলিসাস ঈগল দেখতে পাওয়া গেলেও এখন আর তা চোখে পড়ে না। 

হাওর পাড়ের জেলে শেরাফুল মিয়া বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে আগে নৌকা চালিয়ে গেলেই পানির নিচে মাছ দেখা যেত। মাছ নৌকায় লাফিয়ে উঠত। কিন্তু এখন জাল দিয়েও মাছ পাওয়া যায় না।

ছোট বড়১০৯ টি বিল, ৮৮টি গ্রাম ও ১২৬৫৫.১৪ হেক্টর ভূমি নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। এ হাওরে ভরপুর বিপুল প্রান প্রকৃতির। আমরা পানির উপরে যা দেখি তা ছাড়াও পানির নিচে রয়েছে হাওরের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। টাঙ্গুয়ার হাওরে পানির নিচে থাকা উদ্ভিদ প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছের বাসস্থান এবং খাদ্যের জোগান দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলাভূমির আধার টাঙ্গুয়ার হাওরটি বর্তমানে পরিবেশগত-ভাবে সংকটে পড়েছে। কর্তৃপক্ষের সঠিক নজরদারীর অভাবে অবাধে কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাণ হিজল-করচের বাগান। উচ্চ শব্দের মাইক আর নৌকা নিয়ে পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত বিচরণে হাওর হারাচ্ছে তার নিজস্ব জৌলুশ। পর্যটকদের ফেলে যাওয়া ময়লা আর প্লাস্টিকে সয়লাব টাঙ্গুয়ার হাওরের চারপাশ। গুরুত্বপূর্ণ এই হাওরটির এমন বেহালদশা ও অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয় মানুষ ও হাওর নেতারা।

প্রাকৃতিক সম্পদ আর সৌন্দর্যে ভরপুর টাঙ্গুয়ার হাওরকে বৈশ্বিক গুরুত্বের কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মাদার ফিশারিজখ্যাত এই হাওর মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষিত। প্রতি বছর উৎপাদন হয় লাখ লাখ টন মাছ। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।

জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ একটার সঙ্গে আরেকটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই হাওরের পরিবেশ ঠিক না থাকলে থাকবে না মাছ ও গাছ। মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় দিন দিন কমে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা। মাছ, গাছ আর পাখি না থাকলে হারিয়ে যাবে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীব-বৈচিত্র্য। আর এসব হারিয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যাবে অপার সম্ভাবনাময়ী টাঙ্গুয়ার পর্যটন খাত। তাই টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাঁচিয়ে রাখতে হাওরের প্রত্যেকটি উপাদানকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন হাওর পাড়ের মানুষরা।

কারেন্ট জাল বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও অবাধে কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ মারতে দেখা যায় জেলেদের। বংশ পরম্পরায় নতুন নতুন সরঞ্জাম দিয়ে মাছ আহরণ করছে হাওড় পাড়ের জেলেরা। আর প্রজনন মৌসুমের শুরুতেই মাছ ধরার কারনে দিন দিন মাছের বংশ ধ্বংস হচ্ছে। ফলে হাওর থেকে মাছ একবারেই হারিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে প্রতি বছরই মাছ ধরার নতুন নতুন পদ্ধতি ও জাল আবিষ্কার করছে কারিগররা। কারেন্ট জাল কোনা জাল, বেরজাল, চাই, কিরনমালাসহ বিভিন্ন মাছ ধরার সরঞ্জাম ব্যবহারের পর গত দু বছর ধরে হাওরে এসেছে চায়না দুয়ারী নামে মাছ ধরার নতুন এক ধরনের জাল। ডিমওয়ালা মাছ থেকে শুরু করে সব ধরনের জলজ প্রাণী এই জালে আটকা পড়ায় হাওর-পাড়ের অধিকাংশ জেলের মধ্যে এ জালের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন হাওর পাড়ের বাসিন্দাগন।

সম্প্রতি সময়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা ও সহকারী কমিশনার ভূমি আসাদুজ্জামান রনি। এ সময় প্রচুর পরিমাণে নিষিদ্ধ জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এরপরও থেমে নেই এই জালের বিস্তার। হাওরে অবাধে বিচরণ করছে এসব জাল নিয়ে জেলেরা।

টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের বাসিন্দা খাইরুল ইসলাম জানান,কিরন মালা,কারেন্টের জাল বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও এই জাল দামে সস্তা,ওজনে হাল্কা ও দ্রুত মাছ ধরায় জেলেদের এটি খুবই পছন্দ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হাওরে মাছ শিকারের জন্য চায়না দুয়ারী জালের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে,যা কারেন্ট জালের মতই নিষিদ্ধ । এই জালের বিশেষত্ব হলো এটি নিখুঁতভাবে মাছ ধরতে সক্ষম। এই জালে একটি গিঁট থেকে আরেকটি গিঁটের দূরত্ব খুব কম,যে কারণে এতে যে কোনো মাছ একবার ঢুকলে আর বের হতে পারে না। বর্তমানে জেলার হাওরাঞ্চলে অবাধে এই চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে মাছের বংশ নির্বংশ করা হচ্ছে।

হাওরের জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায়,মাছ ধরার অন্যান্য উপকরণের মধ্যে চায়না দুয়ারী জালে মাছ ধরা সহজ। নদী, প্লাবনভূমি, হাওর সর্বত্র এই জালটি সহজে ব্যবহার করা যায়। এই জালের দুই পাশে দুই হাত পর পর লোহার তৈরি গোল রিং পরানো থাকে। তার মাঝখানে এক হাত পর পর ৩০টির মতো চারকোনা রিং পরানো। চারকোনা রিংয়ের মাঝে একটি করে দুয়ার রয়েছে। এসব দুয়ার দিয়ে মাছ ও জলজ প্রাণী একবার ঢুকে পড়লে বের হতে পারে না। এই জালের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, পানির তলদেশে লম্বালম্বিভাবে পড়ে থাকে। ফলে কোনো ধরনের খাদ্যদ্রব্য ছাড়াই দুই দিক থেকে মাছ ও জলজ প্রাণী জালের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এক একটি দুয়ারী লম্বায় প্রায় ৪০হাত হয়। 

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, হাওর এলাকায় চায়না দুয়ারী জালসহ মৎস্য সম্পদের জন্য ক্ষতিকর মাছ ধরার চাই ও জাল ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়াও মৎস্য আইন গুরুত্ব সহকারে প্রয়োগ করতে না পারলে মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাবে এবং হাওরের নানা জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়বে। এই জালের বহুল ব্যবহার মৎস্য সম্পদের জন্য ক্ষতিকর।

সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ শামছুল করিম জানান, বর্ষাকালে পানিতে মাছ যখন প্রজননের জন্য ছড়িয়ে পড়ে তখন এই জালে ডিমওয়ালা মাছসহ নির্বিচারে সব বয়সের মাছ আটকা পড়ে। এই জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকায় গোপনে জেলেরা এটি দিয়ে মাছ মারছে। অপরদিকে বিলের তলা শুকিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মাছ শিকার করায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মিঠাপানির মাছ। এই জাল বিক্রয়কারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানান, যে বা যারা পরিবেশ, জলজ প্রাণী ও মাছের জন্য ক্ষতিকর জাল বিক্রি করবে ও ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলার বিভিন্ন হাওরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেক জাল জব্দ করে পোড়ানো হয়েছে, মৎস্য সম্পদ রক্ষায় অভিযান অব্যাহত থাকবে।
সর্বশেষ সংবাদ
‘গণহত্যার জন্য যাদের অনুশোচনা নেই, তারা রাজনীতি করারও অধিকার হারিয়েছে’

‘গণহত্যার জন্য যাদের অনুশোচনা নেই, তারা রাজনীতি করারও অধিকার হারিয়েছে’